ক্লিকবেইট বনাম খাঁটি সংবাদ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার লড়াই | Clickbait vs. Authentic News: Brahmanbaria's Media

ক্লিকবেইট বনাম খাঁটি সংবাদ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার লড়াই..




ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নামটা শুনলেই আমাদের অনেকের চোখে কী ভাসে? সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো অদ্ভুত সব খবরের শিরোনাম, তাই না? সংঘর্ষ, বিবাদ, আর সব অবিশ্বাস্য ঘটনা—যেন এটাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটাই কি আসল চিত্র? এখানকার সব মিডিয়াই কি শুধু চটকদার শিরোনামের পেছনে ছুটছে? নাকি এই ক্লিকের দৌড়ের আড়ালে খাঁটি সাংবাদিকতার লড়াইটা আমরা দেখতেই পাচ্ছি না? চলুন, আজ এই ব্যাপারটারই গভীরে যাই আর খুঁজে বের করি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ায় ক্লিকবেইট আর আসল সংবাদের এই লড়াইয়ের সত্যটা ঠিক কী।



প্রথম অধ্যায়: সমস্যাটা কোথায় আমাদের প্রিয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াv?


কিছুদিন আগে একটা খবর খুব ভাইরাল হয়েছিল—ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাকি এক সংঘর্ষে নারীরাও অংশ নিচ্ছেন, হাতে আবার স্বয়ংক্রিয় ধনুকের মতো অস্ত্র! খবরটা ইন্টারনেটে ছড়াতেই শুরু হয়ে গেল ট্রল আর হাসাহাসি। শিরোনামগুলো এমন ছিল, যেন ঘটনার পেছনের কারণটা বড় কথা নয়, উত্তেজনাটাই আসল। অথচ, ভেতরের খবরটা পড়লে হয়তো জানা যেত, ঘটনাটা একটা দীর্ঘদিনের গ্রামীণ বিবাদের অংশ আর এর পেছনে অনেক জটিল সামাজিক কারণ আছে। কিন্তু শিরোনাম আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করলো—"দেখুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবার নারীরাও মাঠে নেমেছে!"



এটাই হলো ক্লিকবেইটের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ। শিরোনামের চটক দিয়ে পাঠককে টেনে আনা হয়, কিন্তু সংবাদের আসল উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে যায়। আর এটা কিন্তু কোনো একটা ঘটনা না। "হেলমেট পরে সংঘর্ষ" বা "টর্চের আলোয় তিন ঘণ্টার মারামারি"—এই ধরনের শিরোনামগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রায়ই দেখা যায়। পাঠক হিসেবে আমরা এগুলো দেখে হয়তো মজাও পাই, বিনোদন খুঁজি। কিন্তু একবারও কি ভেবেছি, এই ধরনের সাংবাদিকতা দিনের শেষে ওই অঞ্চলের মানুষদের জীবন, তাদের আসল সমস্যা আর বাস্তবতাকে কীভাবে তুলে ধরছে?



যখন একটা জেলার পরিচয় কেবল সংঘর্ষ আর নেতিবাচক খবরে আটকে যায়, তখন সেখানকার শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন আর সাধারণ মানুষের ভালো কাজগুলোর গল্প হারিয়ে যায়। সাংবাদিকতার মূল কাজ তো তথ্য দেওয়া, সমাজের আয়না হওয়া। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য যখন শুধু ভিউ বা ক্লিকের প্রতিযোগিতায় আটকে যায়, তখন কি আর সেটাকে সাংবাদিকতা বলা চলে? এই ক্লিকবেইটের সংস্কৃতি কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার গভীরে শেকড় গেড়েছে? নাকি পুরোটাই ওপরের খোলস?



দ্বিতীয় অধ্যায়: এমনটা কেন হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ায় ?



প্রশ্ন হলো, এমনটা হচ্ছে কেন? কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো একটা ঐতিহাসিক জেলার মিডিয়ার বিরুদ্ধে প্রায়ই ক্লিকবেইটের অভিযোগ ওঠে? এর পেছনের কারণগুলো বেশ জটিল।



প্রথম আর সবচেয়ে বড় কারণটা হলো টাকা-পয়সার চাপ। গত দশ বছরে মফস্বল শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর ফেসবুক পেজ গজিয়ে উঠেছে। এদের বেশিরভাগই চলে বিজ্ঞাপনের টাকায়, আর অনলাইন বিজ্ঞাপনের টাকা আসে ‘ভিউ’ বা ‘ক্লিক’ থেকে। যার সাইটে যত বেশি পাঠক, তার আয় তত বেশি। এই কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকেই সহজ রাস্তাটা বেছে নেয়—আর সেটা হলো ক্লিকবেইট। একটা গভীর, গবেষণাধর্মী রিপোর্টের চেয়ে একটা চটকদার শিরোনাম অনেক দ্রুত ভিউ এনে দেয়। ফলে, সংবাদের মানের চেয়ে সংখ্যার দিকেই মনোযোগ চলে যায়।



দ্বিতীয় কারণ প্রশিক্ষণের অভাব। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সহজ হওয়ায় এখন যে কেউই একটা ফেসবুক পেজ খুলেই নিজেকে 'সাংবাদিক' বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকতা একটা বিশেষ পেশা, যার জন্য প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা আর দায়বদ্ধতা জরুরি। সঠিক ট্রেনিং ছাড়া অনেকেই বোঝেন না—কোনটা খবর আর কোনটা গুজব, ফ্যাক্ট-চেকিং কেন জরুরি, বা শিরোনাম তৈরির নৈতিক সীমা কোনটা। তাদের কাছে, যা কিছু ভাইরাল হতে পারে, সেটাই খবর। এর ফলে হলুদ সাংবাদিকতা বাড়ছে, আর পুরো পেশাটার ওপর থেকেই মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে।



আর তৃতীয় কারণটা আঙুল তোলে আমাদের, অর্থাৎ দর্শকদের দিকে। আমরা কী দেখতে চাই? একটা গভীর বিশ্লেষণ, নাকি একটা উত্তেজনাকর সংঘর্ষের ভিডিও? সত্যি বলতে, বেশিরভাগ সময়ই আমাদের আঙুল ঐ উত্তেজনাকর ভিডিওর দিকেই যায়। আমাদের এই উত্তেজনার প্রতি আগ্রহকেই পুঁজি করে ক্লিকবেইটের ব্যবসা চলে। মিডিয়া আমাদের যা দেখাচ্ছে, তার পেছনে আমাদের চাহিদাও একটা বড় কারণ। কাজেই, দায়টা শুধু মিডিয়ার কাঁধে চাপালে চলবে না, পাঠক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায় আছে।



তৃতীয় অধ্যায়: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুদ্রার অপর পিঠ:


তবে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই শুধু ক্লিকবেইট আর সংঘর্ষের খবর—এই ধারণাটাও পুরোপুরি ঠিক না। এই জেলার ভেতরেই এমন অনেক সাংবাদিক আর সংবাদমাধ্যম আছে, যারা হাজারটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আসল সাংবাদিকতার চর্চা করে যাচ্ছেন।



আমাদের অনুসন্ধানে আমরা দেখেছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় পত্রিকা আর তাদের অনলাইন সংস্করণগুলো এখনও সংবাদের মান ধরে রাখতে লড়ছে। যেমন ধরুন, যখন একটা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে গ্যাসের পাইপলাইন ফেটে পুরো শহরে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন একটা ক্লিকবেইট পোর্টাল শিরোনাম করতে পারে, "বিস্ফোরণের আশঙ্কায় কাঁপছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া!" এতে হয়তো তারা কিছু ক্লিক বেশি পাবে।



কিন্তু একটা দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম ঠিক এই ঘটনাটাই তুলে ধরে ভিন্নভাবে। তারা শিরোনাম করে, "সড়ক নির্মাণকাজে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত, শহরে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ, ভোগান্তিতে মানুষ"। এই শিরোনামটা তথ্য দেয়, উত্তেজনা ছড়ায় না। তাদের রিপোর্টে ঘটনার কারণ, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে, আর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যসহ সব বিস্তারিত তথ্য থাকে। কিছুদিন আগে একটি মহিলা মাদ্রাসায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে কয়েকজন ছাত্রী আহত হয়। ক্লিকবেইট মিডিয়া হয়তো এটাকে অতিরঞ্জিত করে ভয়ানক কিছু হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু ভালো মিডিয়াগুলো ঘটনার সঠিক বিবরণ, আহতদের অবস্থা আর মানুষের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে, যা খাঁটি সাংবাদিকতার পরিচয় দেয়।



ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন প্রবীণ সাংবাদিক নাম না প্রকাশের শর্তে আমাদের বলেছেন, “অনলাইন ভিউয়ের এই খেলাটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় দেখি, একটা ভিত্তিহীন খবর হাজার হাজার শেয়ার হচ্ছে, আর আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেটে বানানো অনুসন্ধানী রিপোর্ট কেউ পড়ছেও না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই। আজ না হোক কাল, পাঠক ঠিকই পার্থক্যটা বুঝবে।”



এই তুলনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব মিডিয়া এক পথে হাঁটছে না। একদিকে যেমন ক্লিকের দৌড়ে নীতি বিসর্জন দেওয়ার উদাহরণ আছে, তেমনই কঠিন পরিস্থিতিতেও সাংবাদিকতার আদর্শকে ধরে রাখার লড়াইটাও চলছে। এই ভালো কাজগুলো হয়তো চটকদার খবরের ভিড়ে আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু এরাই গণতন্ত্র আর তথ্যের অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার আসল সৈনিক।



চতুর্থ অধ্যায়: সমাধান কী এবং আমাদের কী করার আছে?


তাহলে এই পরিস্থিতির সমাধান কী? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়া কি এই ক্লিকবেইটের চক্র থেকে বেরোতে পারবে? এর উত্তরটা শুধু সাংবাদিকদের হাতে নেই, অনেকটাই নির্ভর করছে আমাদের, অর্থাৎ সাধারণ পাঠকের ওপর।


প্রথমেই, আমাদের হতে হবে একজন ‘সচেতন পাঠক’। যেকোনো চটকদার বা অবিশ্বাস্য শিরোনাম দেখেই সেটা বিশ্বাস বা শেয়ার করা থেকে নিজেকে আটকাতে হবে। একটা খবর পড়ার সময় কয়েকটি জিনিস খেয়াল রাখা জরুরি:

১. খবরটার উৎস কী? এটা কি কোনো প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া, নাকি নাম-পরিচয়হীন কোনো ফেসবুক পেজ?

২. শিরোনামের সাথে ভেতরের লেখার মিল আছে কি? নাকি শিরোনামেই সব উত্তেজনা শেষ?

৩. খবরটাতে কি বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য আছে? নাকি এটা একপেশে?



দ্বিতীয়ত, ভালো সাংবাদিকতাকে সাপোর্ট করতে হবে। যখনই কোনো গভীর, তথ্যবহুল রিপোর্ট পড়বেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করুন, অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। আমাদের একটা শেয়ার বা একটা ভালো মন্তব্যই একজন সাংবাদিককে তার ভালো কাজটা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। আমরা যখন ভালো কনটেন্টকে পুরস্কৃত করবো, তখন মিডিয়াগুলোও মানসম্পন্ন রিপোর্ট তৈরিতে আগ্রহী হবে।



তৃতীয়ত, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব বুঝতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিকরাই একটা অঞ্চলের ভেতরের খবর, সমস্যা আর সম্ভাবনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা তাদের কাজে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। একটা সুস্থ গণমাধ্যমের পরিবেশ তৈরি না হলে খাঁটি সাংবাদিকতা বিকশিত হওয়া অসম্ভব। দিনশেষে, আমরা যা চাইবো, মিডিয়া তাই পরিবেশন করবে। আমরা যদি ক্লিকবেইটকে rechaz করি আর তথ্যভিত্তিক সংবাদকে বেছে নিই, তাহলে মিডিয়ার চিত্রটা বদলাতে বাধ্য।



ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার লড়াই নিয়ে শেষ কথা:



সুতরাং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার চিত্রটা সাদাকালো নয়, বরং বেশ ধূসর। এখানে যেমন ক্লিকের প্রতিযোগিতা আছে, তেমনই আছে নীরবে কাজ করে যাওয়া একদল নিষ্ঠাবান সাংবাদিকের লড়াই। একদিকে ভাইরাল হওয়ার সহজ লোভ, অন্যদিকে সত্যকে তুলে ধরার কঠিন দায়িত্ব—এই দুইয়ের মাঝেই দুলছে এখানকার গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ।



এই আলোচনাটা যদি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তবে তাদের সাথে শেয়ার করুন যারা সংবাদের পেছনের সত্য জানতে আগ্রহী। আর এমন বিশ্লেষণমূলক কন্টেন্ট আরও পেতে চাইলে আমাদের সাথেই থাকুন ।



সবশেষে, একটা প্রশ্ন আপনার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কি শেষ পর্যন্ত দর্শকদের হাতে, নাকি সাংবাদিকদের হাতে? আপনার কী মনে হয়? নিচের কমেন্ট বক্সে আমাদের জানান।


নবীনতর পূর্বতন