তিতাস পাড়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তিতাস নদীর জন্য বিখ্যাত। অদ্বৈত মল্লবর্মণের “তিতাস একটি নদীর নাম” এই অঞ্চলের নদী, জীবনযাত্রা, এবং সংস্কৃতিকে অনন্যভাবে তুলে ধরেছে, যা তিতাস ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিচিতি দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। তিতাস নদী মেঘনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা অতিক্রম করে আবার মেঘনাতে মিলিত হয়েছে। নদীটির মূল ধারা ইংরেজি "এম" আকৃতির মতো। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১২৫ মাইল।
তিতাস ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও কয়েকটি নদী "তিতাস" নামে পরিচিত। যেমন:
নবীনগরের কালিগঞ্জ থেকে উৎপন্ন এবং মেঘনায় পতিত একটি নদী।
দরিকান্দি থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে ঘাঘুটিয়ার কাছে মিশে যাওয়া নদী।
পান্ডুগড় থেকে উৎপন্ন হয়ে চিতিগঙ্গা নামক শাখায় যুক্ত একটি নদী।
তিতাস ও জীবনের ছন্দ
তিতাস নদী এখানকার মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। নদীপাড়ে জেলে সম্প্রদায় মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষকরা মৌসুমে খালে-বিলে মাছ ধরে। এছাড়া, হাওড়, খাল-বিল, এবং পুকুরে দেশি-বিদেশি মাছ চাষ করা হয়।
সরাইলের হাঁসলি মোরগ
সরাইল উপজেলার হাঁসলি বা আসলি মোরগ তার উচ্চতা, শক্তি এবং যুদ্ধক্ষমতার জন্য প্রসিদ্ধ। মোঘল আমলে সরাইলের দেওয়ান মনোয়ার আলী ইরান থেকে বিশেষ প্রজাতির যুদ্ধবাজ মোরগ আনেন। এ মোরগগুলো জেদী এবং যুদ্ধপরায়ণ। মোরগ লড়াই সরাইল অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য, যার জন্য একটি ভালো মোরগের দাম ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকার মধ্যে হয়।
ভাদুঘরের বান্নি মেলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে ভাদুঘরের বান্নি মেলা অন্যতম। চৈত্র মাসে বারুণী স্নানের সময় এটি শুরু হয়। মেলা এলাকার বাসিন্দারা আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই মেলা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
পুতুল নাচের ঐতিহ্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুল নাচ দেশজুড়ে পরিচিত। প্রথম পুতুল নাচ নবীনগরের বিপিন পাল শুরু করেন। এরপর ধন মিঞা আধুনিক পুতুল নাচের প্রচলন করেন। তাঁর নাচের দল ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশংসা অর্জন করে। ধন মিঞা পুতুল নাচের মাধ্যমে সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেন, যেমন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচার।
তিতাসের নৌকা বাইচ
তিতাস নদীর ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ একসময় গণউৎসবে পরিণত হয়েছিল। ইংরেজ শাসনামলে বিভিন্ন পাট কোম্পানি এই প্রতিযোগিতায় সোনার মেডেল দিত। বিশেষত মনসা পূজা উপলক্ষে ভাদ্র মাসে এ প্রতিযোগিতা হত। বিজয়ী নৌকা মেডেল, কাপ, পাঁঠাসহ নানা উপহার পেত।
মিষ্টি ও ছানামুখি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টি ও ছানামুখির ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো। কাশীর মহাদেব পাঁড়ে এখানে আসার পর ছানামুখি তৈরি করেন, যা এখনও দেশের অন্য কোথাও তৈরি হয় না। তাঁর তৈরি মিষ্টি "লেডি ক্যানি" দেশ-বিদেশে সমাদৃত। এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এই দিকগুলো আজও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি ধরে রেখেছে।
